অষ্টম অধ্যায়: বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী
বিষয়-সংক্ষেপ
বাংলাদেশে বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী বাঙালিদের পাশাপাশি বিভিন্ন
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বাস করে। এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার রয়েছে নিজস্ব জীবনাচার
ও সংস্কৃতি। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অধিকারী বাংলাদেশের এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর
মধ্যে রাঙামাটি, বান্দরবান
ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী প্রধান ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হলো চাকমা। চাকমারা বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তুলনায় বেশ শিক্ষিত। বাংলাদেশের
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে গারোরা হচ্ছে
সংখ্যাগরিষ্ঠ। গারোদের সমাজ মাতৃসূত্রীয়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বসবাসকারী
ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে একটি প্রধান নৃগোষ্ঠী হলো সাঁওতাল। সাঁওতালদের মধ্যে
শিক্ষিতের হার খুব কম। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে
মারমারা জনসংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে। মারমারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। রাখাইনরা
বাংলাদেশের আর এক উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পটুয়াখালি, বরগুনা ও কক্সবাজার জেলায় তাদের বসবাস। এভাবে সারা
বাংলাদেশে অনেকগুলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আবাস রয়েছে। তারা সবাই বাংলাদেশি। বিচিত্র
সংস্কৃতি নিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এসব মানুষেরা বাংলাদেশের জীবন ও সংস্কৃতিকে
বর্ণিল করেছে।
পাঠ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি
বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভৌগোলিক অবস্থান :
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি, উত্তর-পূর্বাংশে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেট,
উত্তর-পশ্চিমাংশের
দিনাজপুর, রংপুর,
রাজশাহী, বগুড়া, এছাড়াও কক্সবাজার, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র
জাতিসত্তার অবস্থান।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তা: বাংলাদেশে বৃহত্তর নৃ-গোষ্ঠী বাঙালিদের
পাশাপাশি বহুভাষাভাষী মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছে। যেমন: চাকমা, গারো, মাহালি, খাসিয়া, সাঁওতাল,
মারমা, রাখাইন ইত্যাদি। এরাই হলো
ক্ষুদ্র জাতিসত্তা।
চাকমা: বাংলাদেশের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী প্রধান ক্ষুদ্র
জাতিসত্তা হলো চাকমা। নৃ-তাত্তি¡ক
বিচারে চাকমারা মঙ্গোলিয় নৃ-গোষ্ঠীর লোক। তাদের মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপটা, চুল সোজা এবং কালো, গায়ের রং ঈষৎ হলদেটে।
বাংলাদেশের বাইরেও চাকমারা ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচলে বসবাস করে।
গারো: বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র
জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে গারোরা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ জাতিগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ছিল
তিব্বত। গারোরা সাধারণত ‘মান্দি’ নামে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করে। গারোরা
মঙ্গোলিয় নৃ-গোষ্ঠীর লোক।
সাঁওতাল: বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র
জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে একটি প্রধান নৃগোষ্ঠী হলো সাঁওতাল। তারা রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায় বাস করে।
সাঁওতালরা অস্ট্রালয়েড নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত লোক। তাদের দেহের রং কালো, উচ্চতা মাঝারি ধরনের এবং চুল
কালো ও ঈষৎ ঢেউ খেলানো।
মারমা: বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর
মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে মারমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। মারমা নৃগোষ্ঠীর অধিকাংশই
রাঙামাটি, বান্দরবান
ও খাগড়াছড়ি জেলায় বাস করে। ‘মারমা’ শব্দটি ‘ম্রাইমা’ শব্দ থেকে উদ্ভুত।
রাখাইন: ‘রাখাইন’ শব্দটির উৎপত্তি পালি ভাষার ‘রাখাইন’
থেকে। এর অর্থ হচ্ছে রক্ষণশীল জাতি। বাংলাদেশের পটুয়াখালী, বরগুনা ও কক্সবাজার জেলায় রাখাইনরা বাস করে। রাখাইনরা
মঙ্গোলিয় নৃ-গোষ্ঠীর লোক। তাদের মুখমণ্ডল গোলাকার, দেহের রং ফরসা ও চুলগুলো সোজা।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১) চাকমা সমাজের মুল অংশ কী?
উত্তরঃ চাকমা সমাজের মুল অংশ হলো পরিবার।
২) সাওতাল বিদ্রোহ কখন হয়।
উত্তরঃ বিশ শতকের প্রথম ভাগে সাওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
৩) রাখাইনদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম কী?
উত্তরঃ রাখাইনদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম সাংগ্রাহী।
৪) গারোদের আদি বাসস্থান ছিল কোথায়?
উত্তরঃ গারোদের আদি বাসস্থান ছিল তিব্বত।
৫) চাকমাদের জীবিকার প্রধান উপায় কী?
উত্তরঃ চাকমাদের জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছেকৃষি।
৬) চাকমা সমাজের পাড়ায় প্রধানকে কী বলা হয়?
উত্তরঃ চাকমা সমাজের পাড়ায প্রধানকে কারবারি বলা হয়।
৭) খাসিয়ারা কোন অঞ্চলে বাস করে?
উত্তরঃ খাসিয়ারা সিলেট অঞ্চলে বাস করে।
৮) মারমা শব্দটি কোন শব্দ থেকে এসেছে?
উত্তরঃ মারমা শব্দটি ¤্রাইমা শব্দে থেকে এসেছে।
৯) সাওতাল সমাজের মুল ভিত্তি কী?
উত্তরঃ সাওতাল সমাজের মুল ভিত্তি হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েত।
১০) গারো সমাজেপ্রধান দল কয়টি?
উত্তরঃ গারো সমাজের প্রধান দল পাচটি
১২) সাওতাল সমাজের মুলভিত্তি হলো গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ সাওতাল সমাজের মুল ভিত্তি হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েত
পঞ্চায়েত পরিচালনার জন্য মাঝি পরাণিক থাকে এরা হলো মাঝি হারাম জগমাঝি পরাণিক গোডেং
ও নায়ক নায়েককে তারা ধর্মগুরু হিসেবে গণ্য করে।
১৩) গারোদের ধর্মীয় জীবন ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ গারোদের আদি ধর্মের নাম ছিল সাংসারেক। গারোরা অতীতে
বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করত। তাদের প্রধান দেবতান নাম ছিল তাতারা রাবুগা। গারোরা
সালজং বা সূর্য ছোছুম বা চন্দ্র গোয়েরা বা বজ্র মেন বা মাটি প্রভৃতি দেবদেবর পূজ
করত। নাচ গান ও পশু বলিদানের মাধ্যমে তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করত।
বর্তমানের গারোদের অধিকাংশ লোক খ্রিষ্টান ধর্মাবল্বী । তারা এখন বড়দিনসহ খ্রিষ্ট
ধর্মীয় বিভিন্ন উৎসব পালন করে।
১৪) গারোদের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে লিখ।
উত্তরঃ গারোদের অর্থনৈতিক জবীন কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশের
গারোরা সাধানত কৃষিকাজ কর্ইে জীবিকা নির্বাহ করে । পুর্বে গারোরা জুম চাষে অভ্যস্ত
ছিল। বর্তমানে জুম চাষের প্রচলন নেই বলে চলে। তারা হাল চাষের সাহায্য প্রধানত ধান
নানা জাতের সবজি ও আনারস উৎপাদন করে থাকে।
১৬) মারমাদের অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা ব্যাখ্যা কর
উত্তরঃ মারমাদের জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছে কৃষিকাজ।
তাদের প্রাথমিক কৃষি পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। এ সমাজে নারী পুরুষ সকলেই কৃষিকাজে
অংশগ্রহণ করে। মারমা মেয়েরা কৃষিকাজ ও তাতের কাজে দক্ষ এমনকি তাদের কেউ কেউ
ছোটোখাটো ব্যবসাও করে থাকে।
১৮) সাওতালদের ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ সাওতাল নৃগোষ্ঠী প্রধানত দুটি ধর্মের অনুসারী।
তাদেরকএক অংশ সনাতন হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে এবং এই ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন
করে। অপর অংশ খ্রিষ্টান র্ধম গ্রহণ করেছে এবং তারা খ্রিষ্টান ধর্মে আচার অনুষ্ঠান
পালন করে।
১৯) গারো, হাজং ও কোচ কোথায় বাস করে?
উত্তর : গারো, হাজং ও কোচরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাস করে।
২০) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর খাসিয়ারা কোথায় বাস করে?
উত্তর : ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী খাসিয়ারা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে
বাস করে।
২১) চাকমা সমাজে মূল অংশ কোনটি?
উত্তর : চাকমা সমাজে মূল অংশ হলো পরিবার।
২২) চাকমা পাড়ার প্রধানকে কী বলা হয়?
উত্তর : চাকমা পাড়ার প্রধানকে বলা হয় হেডম্যান।
২৩) গারোরা কোন নৃগোষ্ঠীর?
উত্তর : গারোরা মঙ্গোলিয় নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
২৪) গারো সন্তানরা কার উপাধি ধারণ করে থাকে?
উত্তর : গারো সন্তানরা মায়ের উপাধি ধারণ করে থাকে।
২৫) সাঁওতালরা ধর্মগুরু হিসেবে গণ্য করে কাকে?
উত্তর : সাঁওতালরা ধর্মগুরু হিসেবে গণ্য করে নায়েককে।
২৬) ঝুমুর নাচ কোন জনগোষ্ঠীর উৎসব?
উত্তর : ঝুমুর নাচ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উৎসব।
২৭) মারমাদের গ্রাম প্রধানকে কী বলা হয়?
উত্তর : মারমাদের গ্রাম প্রধানকে রোয়াজা বলা হয়।
২৮) রাখাইনরা কোন জনগোষ্ঠীর লোক?
উত্তর : রাখাইনরা মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠীর লোক।
২৯) রাখাইনদের আদিবাস কোথায়?
উত্তর : রাখাইনদের আদিবাস হলো বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান
অঞ্চল।
৩০) বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা দাও।
উত্তর : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা
প্রভৃতি এলাকায় নানা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোক বসবাস করে। এরা হলোÑ সাঁওতাল, ওরাঁও, মাহালি, মুণ্ডা, উল্লেখযোগ্য।
তাদের দেহের রং কালো, উচ্চতা
মাঝারি ধরনের এবং চুলগুলো কালো ও ঈষৎ ঢেউ খেলানো।
৩১) সাঁওতালদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা কোনটি? বর্ণনা দাও?
উত্তর : সাঁওতাল বিদ্রোহ সাঁওতালদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশ শতকের প্রথম ভাগে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ উপমহাদেশে তথা
সাঁওতালদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই সিধু
ও কানুকে সাঁওতালরা বীর হিসেবে ভক্তি করে।
৩২) মারমাদের অর্থনৈতিক জীবন ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : মারমাদের জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছে কৃষিকাজ। তাদের
কৃষি পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। চাকমাদের মতো মারমারাও এখন হালকৃষিতে অভ্যস্ত
হয়েছে। এ সমাজে নারী-পুুরুষ সকলেই কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করে। মারমা মেয়েরা কৃষিকাজ ও
তাঁতের কাজে দক্ষ। ।
৩৩) মারমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বর্ণনা দাও।
উত্তর : মারমা পুরুষরা মাথায় পাগড়ি, গায়ে জামা ও লুঙ্গি পরে। মহিলারা পরে বøাউজ। কাপড় বোনার কাজে মারমা
নারীরা দক্ষ। তাদের মধ্যে হস্তচালিত ও কোমর উভয় ধরনের তাঁতের ব্যবহার রয়েছে।
মারমারা সাধারণত মাছ-মাংস ও নানা ধরনের শাকসবজি খেয়ে থাকে। তারা পুরাতন বর্ষকে
বিদায় ও নববর্ষবরণ উপলক্ষে সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। এ সময় তারা পানিখেলা উৎসবে মেতে
ওঠে।